দীর্ঘদিন কবরে লাশ হয়ে থেকেও আবার কবর থেকে ওঠে এসে মৃত ব্যক্তি আর কোথাও না গিয়ে সরাসরি হেটে এসেছেন সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে,এমন অলৌকিক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে জালজালিয়াতির আশ্রয়ে সাতকানিয়ায় মৃত ও প্রবাসীসহ ১৯ ব্যক্তির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে নকল বাদী সেজে কেরানীহাট কেন্দ্রীক ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের যোগসাজশে বিএস সংশোধনী মামলা প্রত্যাহারের ঘটনায় আদালত আজিজুল হক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করেছেন।
২৫ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) বিকালে সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারি জজ আদালতের বিচারক শরিফুল হকের আদালতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অন্যান্য অভিযুক্তরা পলাতক রয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃত আজিজ উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের জনার কেঁওচিয়া ডেলিপাড়া এলাকার মৃত কালু মিয়ার ছেলে।
আদালতে দায়েরকৃত অপর মামলার আর্জি থেকে জানা যায়, উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের জনার কেঁওচিয়া চেয়ারম্যান পাড়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন নামে এক ব্যক্তিসহ ১৯ ব্যক্তি ২০১৭ সালে তাদের জায়গার ভুল বিএস সংশোধনের জন্য সাতকানিয়া যুগ্ম জেলা জজ আদালতের একটি মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি ২০২১ সালে সাতকানিয়ার সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে বদলি করা হয়।
মামলাটি পরিচালনা করেন সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারী জর্জ আদালতে আইনজীবী এড.সুজন পালিত। পরে মামলাটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে (এলএসটি) তালিকাভুক্ত হয়। বিষয়টি আদালতে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারী ৩০ ধারার জন্য তদবিরের দিন ধার্য্য ছিল ৩১ জানুয়ারী।
বাদী পক্ষের আইনজীবীর অজান্তে ৫ নং বাদী মো. বেলালসহ অপরাপর বাদীগণের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে প্রতারকচক্র মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন।
পরে মামলার মূল বাদীগণ বিষয়টি জেনে ১১ মার্চ পূর্বের তারিখের আদেশ রহিত করে পূর্বের মামলার নম্বর বহালের আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করে আদালত মূলবাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ধার্য্য করেন আদালত।
এর প্রেক্ষিতে আজ (বৃহস্পতিবার) সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারি জজ আদালতের বিচারক শরিফুল হকের আদালতে আজিজ (বাটা আজিজ)কাছ থেকে জবানবন্দি গ্রহণ করেন বিচারক।
পরে আদালত জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আজিজকে গ্রেপ্তার করে সাতকানিয়া থানা পুলিশের নিকট সোপর্দ করেন।
বাদী পক্ষের অপর আইনজীবী ও সাতকানিয়া আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড.মেজবাহ উদ্দিন কচির বলেন, একটি জালিয়াতী চক্র রহিম বকসু ও মোজাফ্ফর আহমদ নামে দুইজন মৃত ব্যক্তি এবং মো. ইসমাইল নামে একজন প্রবাসী সহ ১৯ জনের স্বাক্ষর জাল করে মো. বেলাল নামে আসল বাদীকে ভুয়া বাদী সাজিয়ে বিএস সংশোধন মামলা আমার অজান্তে প্রত্যাহার করে নেন।
এঘটনায় আদালত (বৃহস্পতিবার) আজিজুল হক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের নিকট সোপর্দ করে।
তিনি আরো বলেন, বাটা আজিজুল হক যে দলিলের গ্রহীতা হয়ে আজকে জালিয়াতী প্রমানিত হয় ওই দলিলের ১নং গ্রহীতা কেঁওচিয়ার মাদারবাড়ী এলাকার ওসমান আলী,এবং একই দলিলের আরেক গ্রহীতা শহিদুল ইসলাম বাবর।
মূলত আদালতের ভাষায় দলিল গ্রহীতারা বেনিফিসিয়ারী তাই বেনিফিসিয়ারী কেউ এই কর্মকান্ডের দায় এড়াতে পারেননা।
এদিকে অনুসন্ধানে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাগেছে দলিল গ্রহীতাদের মধ্যে জালিয়াতি চক্রের যোগসাজশ থাকলেও কেঁওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওসমান আলী এই বিষয়ে কিছু না জেনেও অনেকটা ফেঁসে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা আরো বলেন,চেয়ারম্যান সাহেবের অফিসে টাকা লেনদেন হয়েছে ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে তবে তিনি এসবে জড়িত নয়।
এই বিষয়ে চেয়ারম্যান ওসমান আলী বলেন,আমি এই বিষয়ে বিন্দু মাত্র ও জড়িত নয়, জীবনেও কখনো সাতকানিয়া আদালতে আমি যায়নি এসব কাজ নিয়ে। তবে এটা সত্য ওরা আমার অফিসে আসছিল আমার সামনেই টাকা পয়সা বুঝে নিছে এতটুকু জানি এবং দেখছি।
এখন প্রশ্ন রয়ে গেল, আমি কেন অপরাধী হচ্ছি ! আর এই জনপদের সবাই তো আমাকে চেনে আমি কেমন? আমিও চাই আদালত প্রকৃত দোষীদের বিচার করুক।
এদিকে রাত ১১.২০মিনিটে সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে ঘটে যাওয়া এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে চেয়ারম্যান ওসমান আলী তার ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেন -অপরাধ না করে আজ অপরাধী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে আর কোন বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে না? এই বিচার আল্লাহ কাছে দিলাম আমি প্রশাসন ও জনগণের সহযোগিতা কামনা করছি।
এদিকে আদালতের নথিসূত্রে আরো জানা গেছে ভূয়া বাদী সাজিয়ে আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহার করিয়ে বিবাদী পক্ষের এডভোকেট ক্লার্ক নাজিম উদদীনের পরিচয়পত্র নং ৭৬ ব্যবহার করে আদালতের সেরেস্তা কার্যালয় থেকে মামলা নিস্পত্তির সংবাদ ও সংগ্রহ করেন।
অথচ ! আজ আসল ক্লার্ক নাজিম উদদীন গনমাধ্যমে এক ভিডিও বক্তব্যে বলেন সেটাও জাল করা হয়েছে আমি আমার সাক্ষর কিংবা ক্লার্ক কার্ড ব্যবহার করে কারো জন্য সংবাদের আবেদন করিনি।
এদিকে আরো ভয়ংকর জাল কিংবা প্রতারকের আশ্রয় নেয়া হয়েছে যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী ১৫তারিখে তোলা জাল সংবাদের মাধ্যমে সাতকানিয়া উপজেলা রেজিষ্ট্রেশন অফিসে মূল বাদীর অজান্তে ১৯/৩/২০২৪সালের ১০৭২নং দলিল সৃজন করা হয়।
শুধু তারা আদালতের বিচারাধীন মামলার নথির তথ্য জালিয়াতি করেনি, জালিয়াতি করেছে মুন্সী এডভোকেট ক্লার্ক,তারা আরো জালিয়াতি করেছে সেরেস্তাদার থেকে উত্তোলিত সংবাদ দ্বারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সম্পাদন করেছেন দলিল।
শুধু এতটুকু পর্যন্ত আগায়নি এই এই জালিয়াতি চক্রের দল, তারা ভূয়া ওই দলিল দ্বারা সাতকানিয়া উপজেলা ভূমি(সহকারী) কার্যালয়ে নামজারী খতিয়ান সৃজনের জন্যও আবেদন করেছেন।
এদিকে সাতকানিয়া আইনজীবী সমিতির অন্যতম নেতা এডভোকেট জাহাঙ্গীর বাবুল জানিয়েছেন ৪২০,৪০৬, ৪৬৫,৪৬৮, ৪৬৭, ৪৭১,৪৭৬ ধারার সবগুলি অপরাধ করেছেন গ্রেফতারকৃত আজিজের নেতৃত্বাধীন জাল চক্রের সিন্ডিকেট।
তিনি আরো বলেন এটা তাদের আইনজীবী ও মুন্সির সরাসরি যোগসাজশে হয়েছে।
এদিকে ভূয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে একই দিনে সৃজিত ১০৭১/১০৭২দলিল দুটিতে নামজারী খতিয়ান সৃজন না করার জন্য এডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী কচির সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে প্রার্থনাও করেন।
উল্লেখ্য যে, জাল জালিয়াতির মাধ্যমে একই দিনে ২টি দলিল সম্পাদন করা হলেও বাটা আজিজ আর শহিদুল ইসলাম বাবররা মাত্র একটি দলিলের গ্রহীতা যে দলিলে সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ১গন্ডা দলিলে লেখা আছে মৌজা মূল্য মাত্র প্রায় ৭ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
এডভোকেট শাহাদাৎ হোসাইন হিরু বলেছেন, বাদী না হয়েও False person কে বাদী সাজিয়ে মূল বাদীর অজান্তে মামলা প্রত্যাহার করে দলিল সৃজন এবং নামজারী খতিয়ান সৃজন এটাতো আসলে স্বয়ং মাননীয় আদালতের সাথেই আয়নাবাজি আর চালবাজির মতো।
প্রতারণা করে সৃজিত দলিলের যারাই গ্রহীতা কিংবা দাতা সবাই আইনের কাছে অবশ্যই দোষী এখানে কেউ পার পাবেননা,কারণ আইনের চোখে মূল বিষয়টা হচ্ছে দলিলে কারা বেনিফিসিয়ারী সেটা।
অপরদিকে এডভোকেট রাশেদুল ইসলাম রাশেদ বলেন,এই প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি চক্রটি মোট ৫টি ষ্টেজে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন,তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ ফৌজদারি আইনে আমলযোগ্য।