চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের মৌলভী পাড়া এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন আর এস এম নিজাম উদ্দিন। তিনি মৃত হাজি আবদুর রহিম (মেম্বার) ও ছখিনা খাতুনের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে বড় হওয়ায় শৈশব থেকেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেও নিজের অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি আজ একজন প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা।
নিজাম উদ্দিন বলেন, “পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে ছোটবেলায় লেখাপড়ার সুযোগ সীমিত ছিল। মাত্র দুই বছর মুদি দোকানে কাজ করি। এরপর পাঁচ বছর একটি বেকারিতে কাজ করে ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা অর্জন করি। পিতার সহায়তায় ‘আলাভী বেকারি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি কর্ণফুলী চরলক্ষ্যা মৌলভীবাজারে। কিন্তু কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে মুদি দোকান ও কুলিং কর্নার ব্যবসা শুরু করেও টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।”
একাধিকবার ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে ব্যাংকের ঋণের বোঝায় দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। তবে ভেঙে না পড়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, “হাল না ছেড়ে ঘরোয়া পরিবেশে সিঙ্গারা, চমুচা ও পিঠা তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করতে শুরু করি। স্বপ্ন দেখতাম একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার, কিন্তু অর্থের অভাব সবসময় বাধা হয়ে দাঁড়াত। শেষ পর্যন্ত, পিতার দেওয়া আট শতক জমি বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা সংগ্রহ করি।”
তিনি আরও জানান, “ব্যাংকের ১৫ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধের পর ২০১৮ সালের শেষের দিকে, যখন পুরো বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারিতে বিপর্যস্ত, তখন আমি পাঁচজন কর্মী নিয়ে পুনরায় বেকারির ব্যবসা শুরু করি। পূর্বের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে কর্ণফুলী চরপাথরঘাটা ‘ফ্রেশ অ্যান্ড সেইফ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি। আলহামদুলিল্লাহ, আজ এ প্রতিষ্ঠানে নিজকে যেমন স্বাবলম্বী করতে পেরেছি, তেমনি চারটি শোরুম ১) চরপাথরঘাটা ২) সৈন্যরটেক ৩) কলেজ বাজার ৪) মইজ্যরটেক, এবং ৩৫ জন মানুষের কর্মস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি যারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে”নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে তাদের পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে।
বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠান থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় হয় এবং তিনি নিয়মিত সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদান করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার সফলতার পেছনে স্ত্রী অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস।
তার সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তিনি। বড় ছেলে পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ চতুর্থ সেমিস্টারে অধ্যয়নরত, ছোট ছেলে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত বর্ষে এবং মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
শিক্ষার প্রতি নিজের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে তিনি সমাজে আলোকিত প্রজন্ম গঠনের উদ্দেশ্যে নিজ এলাকা চরলক্ষ্যা মৌলভী বাজার আলভীনগর ২০২১খ্রিঃ‘সাউথ চট্টগ্রাম ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১২ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োজিত রয়েছে,প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ সুবিধা ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান। আর এস এম নাজিম উদ্দিন ভবিষ্যতে তিনি একটি কলেজ ও একটি মেডিকেল প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখছেন, যা সমাজে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
একজন সংগ্রামী উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণার গল্প
আর এস এম নিজাম উদ্দিন শুধুমাত্র একজন সফল ব্যবসায়ী নন, তিনি শিক্ষা, কৃষি ও বাণিজ্যে উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তার প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং উদ্ভাবনী সেবা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে।
তার জীবনসংগ্রাম এবং উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প অনেকে জন্য শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণামূলক। তিনি বিশ্বাস করেন, “সফলতার চাবিকাঠি হলো অধ্যবসায়, সঠিক পরিকল্পনা ও ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা। জীবনে যেকোনো বাধা ধৈর্য, পরিশ্রম এবং ইতিবাচক মানসিকতার মাধ্যমে জয় করা সম্ভব।”
তার এই অনন্য যাত্রা প্রমাণ করে, ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো সম্ভব। এস এম নিজাম উদ্দিনের জীবনগল্প নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।