আকবরশাহ’য় কিশোর গ্যাং এর উৎপাত কোনোভাবেই থামছে না। বরং দিনে দিনে এর পরিধি বাড়ছে। অতি সম্প্রতি নগরের আকবরশাহ থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় নিহত ডা. কোরবান আলী’র মৃত্যুর পর গ্রুপগুলো কিছুদিন নিরব থাকলেও দুই মাসের মাথায় তারা আধিপত্য বিস্তার করতে ফের সরব হয়েছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাত ১০ টার দিকে আকবরশাহ থানাধীন বিশ্ব কলোনীর জি ব্লক কাঁচা বাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার ও সম্প্রতি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন একটি জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সাময়িক বরখাস্ত কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম নিয়ন্ত্রিত ও ঐ এলাকার কিশোর গ্যাং লিডার বেলাল উদ্দিন জুয়েল পরিচালিত কিশোর গ্যাং এর দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার তান্ডব দেখেছে আকবরশাহ’র বিশ্ব কলোনী এলাকার বাসিন্দারা।
স্থানীয় একাধিক সিসি টিভি ক্যামেরায় ঘটনার চিত্র ধরা পড়েছে। হামলার আগে কিশোর গ্যাং লিডার বেলাল উদ্দিন জুয়েল তার ছেলেপেলেদের বাধা ও কর্মকান্ডে বাধা দেয়া নিয়ে একটি বৈঠকের অডিও রেকর্ডও হাতে এসেছে আমাদের হাতে।
এতে বেলাল উদ্দিন জুয়েলকে তার ছেলেপেলেদের পক্ষে হুঙ্কার দিতে দেখা যায়। নিজের গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে তার গডফাদার জহুরুল আলম জসিমকেও গালিগালাজ করে দেখে নেয়ার বিষয়ে অডিও রেকর্ডে উঠে আসে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সাময়িক বরখাস্ত হওয়া স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম নিয়ন্ত্রিত ও তার ঐ এলাকার ডানহাত হিসেবে পরিচিত বেলাল উদ্দিন জুয়েল এর কিশোর গ্যাং দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।
অভিযোগ উঠেছে, আকবর শাহ থানার তালিকাভূক্ত শীর্ষ কিশোর গ্যাং লিডার বেলাল উদ্দিন জুয়েলের একাধিক কিশোর গ্যাং এর অন্যতম একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় তুহিন (১৯) ও স্থানীয় টাংকির পাহাড় এলাকার মানিকের ছেলে তুষার (১৮)। সম্প্রতি একই এলাকায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন একটি জায়গা দখল করে বিক্রি করে বেলাল উদ্দিন জুয়েল। আরাফাত (১৮), মো. সাকিব (১৮), ইমন (১৮) ও মাহফুজ (১৫) এর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ছেলেদেরে নিয়ে দখল করা ওই জমি বিক্রি বাবদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা পায় বেলাল উদ্দিন জুয়েল। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি তারই গ্রুপের আরেক কিশোর গ্যাং লিডার তুহিন (১৯)। ওই সাড়ে চার লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তুহিন স্থানীয় বরখাস্ত কাউন্সিলর ও আলোচিত পাহাড়খেকো জহুরুল আলম জসিমের কাছে বিচার দেয়। সেখান থেকে যেন কিছু টাকা তুহিনকেও দেয়া হয় সে বিষয়েও জানানো হয়। তুহিন জানায়- এই টাকা থেকে জুয়েল তুষার ও তার ছেলেপেলেদের কিছু দিয়েছে, কিছু জসিমকে দিয়েছে, বাকী টাকা সে নিজে রেখেছে। তুহিনও একই গ্রুপ করলেও সে সেই টাকার ভাগ পায়নি। এই কারণে তুহিন জুয়েল গ্রুপের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে সরাসরি জসিম গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটায় গত বুধবার রাতে বেলাল উদ্দিন জুয়েল বৈঠক করে। সেখানে নিজের গ্রুপের জন্য প্রয়োজনে জহুরুল আলম জসিমকেও ছাড় দেয়া হবে না মর্মে হুঙ্কার দিতে শোনা যায় ঐ বৈঠকের একটি অডিও রেকর্ডে। এসময় জুয়েলকে জহুরুল আলম জসিমকে খারাপভাবে গালিগালাজ করতেও শোনা যায়।
এই ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার তুহিন ও তুষারের নেতৃত্বে একদল কিশোরের হামলায় আহত হয় অন্তত চারজন৷ এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া গেছে তুহিনের কিশোর গ্যায়ের সেই হামলার লোমহর্ষক চিত্র।
বৃহস্পতিবার (১৬ মে) রাত আনুমানিক পৌনে ১১ টায় চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানাধীন বিশ্ব কলোনী আবাসিক এলাকার জি ব্লক কাঁচা বাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় আরাফাত (১৮), মো. সাকিব (১৮), ইমন (১৮) ও মাহফুজ (১৫) নামের চারজন আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন৷ তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
কিশোর গ্যাং এর হামলায় আহতদের ভাষ্য ও সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, আহত আরাফাত, মো. সাকিব ও ইমন বাজারের দিক দিয়ে বাসায় ফিরছিল। এসময় কিশোর গ্যাং লিডার তুহিন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড শান্ত ও তুষারের নেতৃত্বে একদল কিশোর বিপরীত দিক থেকে এসে আরাফাতকে টেনে হিচড়ে পাশের একটি গলিতে নিয়ে যাচ্ছে৷ এসময় আরাফাতের সাথে থাকা সাকিব, ইমন ও মাহফুজ কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে আরাফাতকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে তাদের ওপরও হামলে পড়ে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা।
৫ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের সেই সিসিটিভি ফুটেজে এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে এসে কিশোর গ্যাং লিডার তুহিনকে হামলায় যুক্ত হতে দেখা গেছে৷ আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে হামলার পর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে তুহিনকে একটি প্রতিষ্ঠানের সামলে গালাগাল করতে দেখা গেছে।
আহত সাকিব বলেন, আমাদের গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান আছে। আমি দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরছিলাম। এসময় হঠাৎ কিছু ছেলে এসে আমার বন্ধু আরাফাতকে টেনে পাশের গলিতে নিয়ে মারধর শুরু করেছে দেখে আমি তাকে উদ্ধারে চেষ্টা করি৷ এসময় ওরা আমাকেও মেরে আহত করে এবং আমার পকেটে রাখা দোকানের ৩০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
জানা গেছে সেই প্রতিষ্ঠানটি আহত সাকিবের বড় ভাইয়ের৷ স্থানীয়রা জানায়, শান্ত ও তুষারই তাদের ছেলেদের নিয়ে আরাফাত সহ অন্যান্যদের ওপর আকষ্মিক হামলা শুরু করে৷ এসময় স্থানীয় শামিম রাব্বিসহ অজ্ঞাত আরো বেশ কিছু ছেলেকে হামলা চালাতে দেখা গেছে৷ পরে তুহিন এসে ২য় দফা চারজন ছেলেকে পিটিয়ে প্রকাশ্য এলাকায় মহড়া দেয়৷ এসময় তুহিনকে এলাকায় লাশ পড়বে বলে চিৎকার করে হুমকি ধমকি দিতে শোনা যায় বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এই বিষয়ে আকবর শাহ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম রব্বানী জানান, ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর পরই দ্রুত থানার পুলিশ ঘটনাস্থকে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে৷ ইতোমধ্যে হামলায় জড়িত শান্তকে আটক করা হয়েছে। এলাকায় যে বা যারাই আইনশৃংখলা বিরোধী কাজে জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একই সাথে ঘটনায় জড়িত অন্যান্যদের ধরতে রাত থেকেই অভিযান চালানো হয়েছে৷ এই সংক্রান্তে মামলা দায়ের হয়েছে বলেও জানান ওসি গোলাম রব্বানী।
জানা গেছে, রনি, ফয়সাল, তুহিন, তুষার এবং তাদের নেতা বেলাল উদ্দিন জুয়েলের নামে অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা রয়েছে।